১. পিরি রেইসের পরিচিতি: আহমদ মহিউদ্দিন পিরি, রেইস আনুমানিক ১৪৬৫ সালে ইস্তাম্বুল নগরীর পশ্চিমাঞ্চল গ্যালিপোলিতে জন্মগ্রহণ করেন। উসমানীয় যুগের শ্রেষ্ঠ ভূগোলবিদ ও আমেরিকা মহাদেশের সর্বপ্রাচীন মানচিত্রের কারিগর ছিলেন তিনি। মারমারা সাগরের উপকূলবর্তী এই শহরটি(গ্যলিপোলি) অটোমান সাম্রাজ্যের প্রধান নৌ ঘাঁটি ছিল। অটোমান সাম্রাজ্যের শায়খুল ইসলাম আহমদ বিন কামাল পাশা বলেন, ‘গ্যাপোলির অধিবাসীরা কুমিরের মতো নিজেদের পুরো জীবন সমুদ্রে অতিবাহিত করে। নৌ তরীগুলো যেন তাদের পরিবার। সাগর ও জাহাজের মধ্যে তারা দিন-রাত অতিবাহিত করে।

ছবি : আহমদ মহিউদ্দিন পিরি

আঞ্চলিক ঐতিহ্য অনুসারে পিরি রেইস পড়াশোনা শেষ করে চাচার সঙ্গে নৌযাত্রা শুরু করেন। রেইসের চাচা কামাল রেইস অটোমান নৌবাহিনীর নাবিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। চাচার সঙ্গে ভূমধ্যসাগরে অটোমান নৌবাহিনীর সদস্য হয়ে অনেক দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এরপর সুলতানের আমন্ত্রণে নাবিক হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে নৌবাহিনীতে যোগ দেন। ১৫১০ সালে কামাল রেইস ভূমধ্য সাগরে মিসর যাত্রাকালে জাহাজ ডুবে মারা যান।

এরপর মহিউদ্দিন পিরি রেইস অটোমান সুয়েজ নৌবহরের প্রধান নাবিক হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। চাচার মৃত্যুর পর পিরি রেইস অবসর নিয়ে নিজ এলাকা গ্যালিপোলিতে আসেন। ১৫১৩ সালে এখানেই প্রথমবার পৃথিবীর মানচিত্র অঙ্কন করেন।

২. যেভাবে সন্ধান মেলে পিরির মানচিত্রের: উসমানি খেলাফত পতনের পর তুরস্কের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে তোপাকাপি জাদুঘরের গ্রন্থাগারে জার্মান প্রাচ্যবিদ গুস্তাভ অ্যাডলফ ডেইসম্যান (Gustav Adolf Deissmann) কর্মরত ছিলেন। ১৯২৯ সালের ৯ অক্টোবর গ্রন্থাগারের পুরনো বিষয় বিন্যাসকালে হরিণের চামড়ায় আঁকা মানচিত্রের ওপর তাঁর চোখ পড়ে। ষষ্ঠদশ শতাব্দীর প্রাচীন মানচিত্রে আমেরিকার অবস্থান দেখে তিনি বেশ অবাক হন। পিরি রেইস নাবিকের আঁকা মানচিত্রে ৯১৮ হিজরি (১৫১৩ খ্রি.) লেখা ছিল। আধুনিককালে পাওয়া প্রাচীন মানচিত্রগুলোর মধ্যে শুধু পিরি রেইসের মানচিত্রে আমেরিকার অবস্থান পাওয়া যায়। ক্রিস্টফার কলম্বাসের হারানো মানচিত্রের ধারণা পাওয়া যায় পিরি রেইসের মানচিত্রে।

ছবি : পিরি রেইসের মানচিত্র।

৩. প্রথম মানচিত্র: ১৫১৩ সালে পিরি রেইস প্রথমবার পৃথিবীর মানচিত্র অঙ্কন করেন। ১৫১৭ সালে পিরি মানচিত্রটি অটোমান সুলতান প্রথম সেলিমের কাছে পেশ করেন। মানচিত্র তৈরিতে পিরি রেইস ২০টি আঞ্চলিক মানচিত্রের ওপর নির্ভর করেছেন। আরবদের তৈরি ভারতবর্ষের মানচিত্র, পর্তুগিজদের তৈরি ভারত-চীনের চারটি মানচিত্র, কলম্বাসের তৈরি উপকূল ও দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে পশ্চিমাঞ্চলের মানচিত্রের সমন্বয়ে প্রথম মানচিত্রটি তিনি তৈরি করেন। এই মানচিত্রে তিনি আন্দালুসিয়া, পশ্চিম আফ্রিকা, আটলান্টিক মহাসাগর এবং আমেরিকার পূর্ব উপকূলীয় এলাকার চিত্র তুলে ধরেন। এটি বর্তমানে ইস্তাম্বুলের তোপকাপি মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। এতে পিরির স্বাক্ষরও রয়েছে। এই মানচিত্রের সাইজ হল ৬০*৮৫ সেন্টিমিটার।

৪. কিতাব-ই-বাহরি রচনা: সম্ভবত প্রাক-আধুনিক যুগের নেভিগেশন সংক্রান্ত সবচেয়ে বিখ্যাত বইটি হল পিরি রেইস-এর লেখা কিতাব-ই-বাহরি। এই বইয়ে শুধুমাত্র নেভিগেশন সম্পর্কিত বিশদ তথ্য নেই, বরং তার পাশাপাশি ভূমধ্যসাগরের নিকটে অবস্থিত শহরগুলি এবং গুরুত্বপূর্ণ বন্দরগুলির বর্ণনা প্রদানকারী নির্ভুল চার্ট রয়েছে। ভূমধ্যসাগরের প্রধান প্রধান বন্দর, উপসাগর, অন্তরীপ, উপদ্বীপ, দ্বীপপুঞ্জ, প্রণালী এবং নোঙর করার পক্ষে নিরাপদ স্থানগুলি সম্পর্কে বিশদে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বইটি নৌচালনার কৌশল এবং জ্যোতির্বিদ্যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত নৌচালনা সম্পর্কিত তথ্য সম্পর্কিত বিষয়গুলি নিয়ে গভীরে আলোচনা করেছে। এটিতে প্রতিটি দেশ এবং শহরের স্থানীয় লোক এবং তাদের সংস্কৃতি সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। কিতাব-ই-বাহরি মূলত ১৫১১-১৫২১ সালের মধ্যে কোনও এক সময় রচিত হয়েছিল, তবে এই বইটি ১৫১৫ থেকে ১৫২৫ সালের মধ্যে অতিরিক্ত তথ্য এবং আরও বিস্তারিত চার্ট অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে সংশোধন করা হয়েছিল। ১৫২৮ সালে বইটি উপহার হিসাবে সুলতান সুলেমানের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। পিরির এই গ্রন্থটি সব বিস্ময়কর তথ্যে ঠাসা। গ্রন্থে এমন কিছু মানচিত্র আছে যা দেখে আমেরিকানও ইউরোপীয় ভূগোলবিদরা বিস্ময়ের সাগরে রীতিমতো হাবুডুবু খাচ্ছেন। এই চিত্রগুলোকে বর্তমান যুগের সকল ভূগোলবিদ বিশুদ্ধ বলে মেনে নিয়েছেন।

৫. ২য় মানচিত্র অংকন: ১৫২৮ সালে পিরি রেইস দ্বিতীয়বার মানচিত্র অঙ্কন করে সুলতানের কাছে উপস্থাপন করেন। দ্বিতীয় মানচিত্রের এক-ষষ্ঠাংশ পাওয়া গেছে। পিরি রেইসের আঁকা দ্বিতীয় সমৃদ্ধ মানচিত্র দেখে গবেষকরা বিস্ময় প্রকাশ করেন। তবে মানচিত্রের অনেক অংশ অনাবিষ্কৃত হওয়ায় গবেষকরা দুঃখ প্রকাশ করেন।

বিশ্বের সব ইতিহাসবিদের কাছে সর্বশেষ আবিষ্কৃত পিরি রেইসের মানচিত্র খুবই গুরুত্ব বহন করে। কারণ আধুনিককালে পাওয়া প্রাচীন মানচিত্রগুলোর মধ্যে শুধু পিরি রেইসের মানচিত্রে আমেরিকার অবস্থান পাওয়া যায়। আর ক্রিস্টোফার কলম্বাসের মানচিত্রটি হারিয়ে যায়, যা আর কোথাও পাওয়া যায়নি। আমেরিকার পশ্চিমাঞ্চলীয় উপকূলের মানচিত্র আঁকার ক্ষেত্রে পিরি রেইস কলম্বাসের মানচিত্রের সহায়তা নেন বলে ধারণা করা হয়। এই মানচিত্রে তিনি আটলান্টিক মহাসাগরের উপকূলীয় এলাকা তুলে ধরেছেন। এতে গ্রীনল্যান্ড থেকে আমেরিকার ফ্লোরিডা পর্যন্ত অঞ্চলের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। এর সাইজ হচ্ছে ৬৮x৬৯ সেন্টিমিটার। এটিও তোপকাপি মিউজিয়াম এ সংরক্ষিত আছে। আর এটাই হল আমেরিকার উপর বানানো পৃথিবীতে টিকে থাকা সর্বপ্রাচীন মানচিত্র।
২২ আগস্ট, ১৯৫৬ সালে যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি অব জর্জটউনে পিরি রেইস এর মানচিত্র পরিচিত সংক্রান্ত একটি সিম্পোজিয়াম অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে অংশগ্রহণকারী সকল ভূগোলবিদ একথা এক বাক্যে স্বীকার করে নেন, পিরি রেইসের এই মানচিত্র আমেরিকা নিয়ে একটি অলৌকিক কাজ।

৬. রেইস কলম্বাসের বহু আগেই আমেরিকা আবিষ্কার করেছিলেন: তিনি তাঁর রচিত কিতাবুল বাহরিয়া তে লিখেন, ‘আটলান্টিক একটি মহাসমুদ্র। এর ওপারে আছে এক মহাদেশ, যাকে বলা হয় আটলান্টিয়া মহাদেশ। এটিই নয়া দুনিয়া তথা আমেরিকা। রেইস আরো লিখেন, ‘এই মহাদেশটি ৮৭০ হিজরি তথা ১৪৬৫ সালে সামনে এসেছে। ‘আর তা ছিল কলম্বাসের আমেরিকা আবিস্কারের ২৭ বছর আগে। পাদরি গ্যাজুটি লাইন হাম বলেন, ‘ভূগোলের ক্ষেত্রে পিরি রেইস ছিলেন অলৌকিক প্রতিভার অধিকারী। তাঁর চিত্রগুলো এতটাই নিখুঁত যে অবাক না হয়ে কোন উপায় নেই।

৭. সর্বপ্রথম অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের অস্তিত্বের ধারণা প্রদান: ১৯৫২ সালের আগে মানুষ অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের ব্যাপারে কিছুই জানতো না। অথচ সেই ষোড়শ শতকের দিকেই পিরি তাঁর মানচিত্রে অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের পাহাড়ি শ্রেণির বিস্তারিত অবস্থার ডিজাইন অংকন করেছিলেন। অর্থাৎ আধুনিক যুগের ভূগোলবিদগণের নিকট ১৯৫২ এর আগে যে মহাদেশের ব্যাপারে কোন তথ্যই ছিল না, প্রায় ৪৫০ বছর আগে পিরি রেইস তাঁর অসামান্য প্রতিভার মাধ্যমে সেই অঞ্চলের মানচিত্র অংকন করেছেন। মোটকথা পিরিই প্রথম অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের ধারণা প্রদান করেন, কোনরকম তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়াই। ২০ শতকের দিকে কতিপয় ভূগোলবিদ স্যাটেলাইট ইমেজ এর চিত্র নিয়ে সেগুলো পিরির মানচিত্রের সাথে মিলান। ফলাফল দেখে তারা একেবারেই হতবাক হয়ে যান। কারণ তাদের চিত্র ও পিরির মানচিত্র হুবহু মিলে যাচ্ছিল!

৮. পিরি রেইসের মানচিত্রের ৫০০ বছর পূর্তি: পিরি রেইসের আঁকা মানচিত্রটি নথি ও মানচিত্রবিষয়ক বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ২০১৩ সালে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো পিরি রেইসের আঁকা মানচিত্রের ৫০০ বছর পূর্তি উদযাপন করে। ইস্তাম্বুলের মিমার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত তোফ্যান আমিরি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ‘পিরি রেইস ও বিশ্ব মানচিত্র ১৫১৩ : ৫০০ বছরের অস্পষ্টতা’ নামে একটি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ২০ দিন পিরির মানচিত্র প্রদর্শনী করা হয়।

৯. পিরি রেইসের মৃত্যু: ১৫৫৪ সালে ৯০ বছর বয়সে পিরি রেইস লোহিত সাগর ও আরব সাগরে জাহাজের নাবিক ছিলেন। এ সময় পর্তুগিজদের সঙ্গে এক যুদ্ধে পরাজিত হলে রেইসের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে অটোমান আদালতে অভিযোগ করা হয়। যুদ্ধ থেকে রেইস মিসর এলে স্থানীয় লোকেরা সুলতানের কাছে অভিযোগ করে যে রেইস নিজের প্রাণ ও সম্পদ বাঁচাতে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করেছে। মূলত তিনি নিজে ও তাঁর চাচা যুদ্ধলব্ধ সম্পদ থেকে তা পেয়েছিলেন। অবশেষে সুলতান তাঁর মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন এবং সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে তোপাকাপি জাদুঘরে রেখে দেন।

১০. তুর্কি লিরায় মানচিত্রের ছাপ: পিরি রেইসের মানচিত্রটি বর্তমানে তোপাকাপি জাদুঘরে আছে। সাধারণত দর্শকদের জন্য প্রদর্শনীতে তা রাখা হয় না। তবে বিভিন্ন সময় তুরস্কের মুদ্রায় মানচিত্রটির ছবি ছাপা হয়েছিল। ১৯৯৯ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত মানচিত্রের প্রতিকৃতি ছাপা হয়। ডাকটিকেটেও এটি।ব্যবহার করা হয়েছে।

তথ্যসূত্র :

★ দ্য ডায়নামিক সুলতান আবদুল হামিদ খান ও উসমানী খিলাফত পতনের ইতিহাস, ড. আলি মুহাম্মদ সাল্লাবি।
★ আল উসমানিয়্যুনা ফিত তারিখি ওয়াল হাজারা।
★ দৈনিক কালেরকন্ঠ।
★ ওয়ান থাউজেন্ড ওয়ান ইনভেনশনস ওয়েবসাইট।

লিখেছেন: শামীম আনোয়ার

Comment | মতামত জানান: